গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা teachings of gautam buddha
মানব ইচ্ছার স্বার্থে এটি একটি অকাট্য প্রমান বলে ভগবান বুদ্ধদেবের জীবনচরিত আমাদের পক্ষে অনুপ্রেরণাদায়ক ৷ আমরা সকলেই তাঁর জীবন কথা জানি | পার্থিব জীবনের সবকিছু , আপনগৃহ , রাজসিংহাসন , স্ত্রী এবং নবজাত সন্তান ইত্যাদি সর্বস্ব ত্যাগ করে সিদ্ধার্থ সন্ন্যাসী হলেন ৷ তারপর তিনি একজন গুরুর সন্ধানে বের হলেন | বিভিন্ন গুরুর তত্ত্বাবধানে তিনি অনুশীলন করলেন , সেইসব গুরুর যা - কিছু শেখাবার ছিল , তার সবই তিনি শিক্ষা করলেন , কিন্তু শেষ পর্যন্ত কারও শিক্ষায় তিনি তৃপ্ত হতে পারলেন না ৷ সব গুরু এবং শিক্ষকই তাঁকে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন ৷ কিন্তু সিদ্ধার্থ তখনও 'বুদ্ধ ' হননি ..... অতৃপ্তই রয়ে গেলেন | এখন তিনি বুঝতে পারলেন মানবজীবনের অন্তর্নিহিত যে দুঃখ- দুর্দশা , তা থেকে নির্বাণ ও মুক্তির যে- পথ তিনি খুঁজছেন , সনাতনপন্থী গুরুগনের কাছে সে-সব প্রশ্নের কোনো সমাধান নেই ৷ অতঃপর তিনি তাঁর নিজের সেই পথকেই প্রজ্বলিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন | গৃহত্যাগী , অক্লান্ত সত্যান্বেষী একাকী রাজগৃহে এসে উপস্থিত হলেন , এবং রত্নগিরিতে অবস্থান করলে ৷ সেখানেই তিনি রাজা বিম্বিসারের সঙ্গে পরিচিত হলেন ( যিনি সিদ্ধার্থের বোধিলাভের পর তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন ) | বিম্বিসারের রাজসভাতেই বলির জন্য প্রদত্ত একটি ছাগশিশুর জীবনের পরিবর্তে তিনি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন | শান্ত - নির্জনতায় আধ্যাত্মিক সাধনার সুবিধার জন্য এরপর তিনি রত্নগিরি থেকে উরুভেলাতে চলে আসেন , যে- স্থান এখন বুদ্ধগয়া নামে বিখ্যাত ৷ উরুভেলাতেই দীর্ঘ ছ - বছর যাবৎ সিদ্ধার্থ কঠোর তপস্যায় তাঁর স্বর্ণকান্তি দেহকে অস্থিচর্মসার এক কঙ্কালের পরিণত করেন ..... তাঁর তখন একটি প্রতিজ্ঞা , মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন' |
একদিন নিরঞ্জনা নদীতে স্নান সেরে কুটিরের দিকে তিনি ফিরছেন , এমন সময় অত্যান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যান , তাঁকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয় ৷ কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি জ্ঞান ফিরে পান | সেদিন সিদ্ধার্থ বুঝেছিলেন যে নির্বাণ লাভের পথ এটি নয় ৷ এ তো নিছক কঠোর আত্মনিপীড়ন | একটি গ্রাম্য রমনী পূজার জন্য পথে বেরিয়েছিলেন ৷ তাঁর দেওয়া পায়সান্ন গ্রহণ করার পর সিদ্ধার্থ দৈহিক বল আবার ফিরে পেলেন ..... মনও তাঁর ধীরে ধীরে বেশ স্বচ্ছ হয়ে গেল এবং আবার তিনি তাঁর সর্বোচ্চ স্তরের সাধনার উপযোগী শক্তি-সামর্থ্য লাভ করলেন ৷ পূর্বেকার কঠোরতা হ্রাস করে নিজের লক্ষ্যপথে তিনি পূর্বাপেক্ষা আরও দৃঢ় হয়ে উঠলেন ৷ তারপর এক বৈশাখী পূর্ণিমায় অধুনা - বিখ্যাত সেই বিশেষ বোধিদ্রুমের নিচে এক কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে আসন গ্রহণ করলেন ..... "এই আসনেই আমার শরীর শুষ্ক হোক , ত্বক , অস্থি ও মাংশসমূহ লয়প্রাপ্ত হোক , তবুও বহু কল্পের সাধনায় সুদুর্লভ সেই বোধি লাভ না - করা পর্যন্ত এই আসন ত্যাগ করে অন্যত্র যাব না |'
অশ্বঘোষ - রচিত বুদ্ধচরিত ' গ্রন্থে বুদ্ধের জীবনের আরও নানা কাহিনী বর্নিত আছে ৷ উপকথায় ধরনে লিখিত হলেও ইচ্ছাশক্তির অপরাজেয়তা মানব সভ্যতার উপর কি অভিঘাত সৃষ্টি করেছে , সেই বার্তাটি ঐ গ্রন্থে অনবদ্য ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে | বলা হয়েছে ,
" সেই পবিত্রাত্মা উক্ত বোধিদ্রুম অভিমুখে পদব্রজে অগ্রসর হয়ে তার ছায়াতলে আত্মানুসন্ধানে তপস্যানিরত হলেন | তিনি অগ্রসর হওয়া মাত্র পৃথিবী কেঁপে উঠলো আর এক অত্যুজ্জ্বল দিব্য আলোকে পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়ে উঠল | যখন তিনি আসনে উপবিষ্ট হলেন , স্বর্গে আনন্দ প্রতিধ্বনিত হল এবং সমগ্র প্রাণীজগৎ খুশিতে ঝলমল করে উঠল ৷ "
' মার ' নামে এক অশুভাত্মা অসুর ছিল .... সে স্থূল পঞ্চবাসনার অধিপতি , মৃত্যুর প্রতীকস্বরূপ এবং সেই কারণেই সত্যের চিরশত্রু | সে একাই কেবল ছিল বিষন্নবদন এবং এই জগৎ - ব্যাপী আনন্দোৎসবে সে তাই যোগদান করতে পারেনি ৷ মানুষকে প্রলুব্ধ করার উপযোগী তার তিন কন্যা ছিল ..... সেই তিন কন্যা ও অন্যান্য অসুর অনুচরদের সঙ্গী করে সেই মার উপস্থিত হলেন ( ওই মহান যেখানে আসন গ্রহণ করেছিলেন , সেইখানে ) কিন্তু শাক্যমুনি সেদিকে কোন লক্ষ্যই করলেন না ৷ মার তাঁকে ভয়াবহভাবে হুমকি দিতে লাগল এবং প্রচন্ড এক ঘূর্ণিঝড় তুলে সারা আকাশ তমসাচ্ছন্ন করে দিল , যার ফলে সমুদ্র হলো আলোড়িত আর বায়ুমণ্ডল হলো প্রকম্পিত | কিন্তু বোধিদ্রুমতলের ঐ পবিত্রাত্মা নির্ভয় ও অচঞ্চল রইলেন ..... কারণ ঐ মহাজ্ঞানী পুরুষ জানতেন যে , এসব কিছু তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা |
মারের তিন কন্যা অতঃপর বোধিসত্ত্বকে যথারীতি প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করল , কিন্তু তিনি ওদের কোনো ভ্রুক্ষেপই করলেন না I যখন মার দেখল যে , কোনভাবেই ওই বিজয়ী শ্রমণের অন্তরে কোন বাসনা - কামনার উদয় করানো গেল না , তখন তার সব অসুর সঙ্গীদের সে হুকুম দিলো ওই তাপসকে আক্রমণ ও পরাস্ত করতে |
কিন্তু সেই মহাত্মা তাদের দিকে এমনভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন যেন তিনি একদল শিশুর খেলাধুলা দেখছেন | অসুরদের ভয়াবহ ও ঘৃণ্য ক্রিয়াকর্মও সব নিষ্ফল হয়ে গেল , নরকের প্রজ্জ্বলিত অগ্নি শিখাগুলিও ধীরে ধীরে সুগন্ধি মলয় বাতাসে রূপান্তরিত হল .... ক্রুদ্ধ বজ্রপাতের পরিবর্তে চারপাশ কমলবনে শোভিত হয়ে উঠল ৷ এ দৃশ্য দেখে মার তার সব অনুচরবর্গসমেত বোধিদ্রুম অঞ্চল ত্যাগ করে পলায়ন করল ৷ স্বর্গের ঊর্ধ্বলোক থেকে তখন পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল এবং এক দৈববাণী শ্রুতিগোচর হল ,
" পরম আশীর্বাদ তোমায় , হে তাপস ৷ "
তাঁর মন ঘৃণায় নির্বিকার , দুষ্ট- দানবদের পাপচক্রের প্রচন্ডতম আক্রমণেও তিনি অজেয় - নির্ভয় . . . . . তিনি পবিত্র ও প্রজ্ঞাময় ..... প্রেম ও করুণায় পরিপূর্ণ ৷
সূর্যালোকের সুবর্ণরস্মিতে যেমন পৃথিবীর সমগ্র তামস- আঁধার দূরীভূত , তেমনি আত্মানুসন্ধানে যিনি ধৈর্যশীল , তার সত্যলাভ অনিবার্য এবং সত্যের দিব্য আলোকেই তিনি স্বয়ং - ভাস্বর |
মারের এই পরাজয়ের পর সিদ্ধার্থ পুনরায় ধ্যানে নিমগ্ন হলেন এবং সেই রাত্রেই ঐ সিদ্ধাসনে বোধি লাভ করে তথাগত অর্থাৎ বুদ্ধ নামে বিখ্যাত হলেন ৷ মানুষের ইচ্ছাশক্তির সাফল্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে পৃথিবীতে এ- এক অতুলনীয় জীবনকথা ৷
ইচ্ছাশক্তি একেবারেই নেই , এমন মানুষ আমাদের মধ্যে একজনও নেই | অন্যথায় আমরা এখন যে - অবস্থায় রয়েছি , তাও থাকতে পারতাম না | তবে এ- কথা সত্য যে , আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ইচ্ছাশক্তির তারতম্য যাই হোক , ইচ্ছাশক্তি যতটা ঈশ্বরাভিমুখী করা যাবে , ততই আমরা মহত্তর হয়ে উঠতে পারব | আর যেসব অমিতবীর্য মহাত্মা মহৎ হয়েই আত্মতৃপ্ত হন না , কেবল তারাই অজেয় ইচ্ছাশক্তির বিকাশে সত্যলাভে সমর্থ | ঈশ্বরেচ্ছায় অনেক কিছুই তো মানুষের জন্য চিরউন্মুক্ত, এখন এর কতটুকু আমরা গ্রহণ করব , সেটাই প্রশ্ন | সংগৃহীত